বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি করার সকল নিয়ম জানুন
বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি ও রোগমক্ত ,পুষ্ট ও অধিক ফলনের জন্য আমাদের
প্রথমে বীজতলা তৈরি ও বীজ উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। বীজ
উৎপাদনের জন্য সর্বপ্রথম ধানের বীজতলা তৈরী জমি নির্বাচন করতে হবে।
সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করে ধানের চারা তৈরি করতে পারলে ধানের ফলন অগ্রিম ১৫ থেকে
২০% বেশি আশা করা যা। চলুন নিচে জেনে নেই বোরো ধানের আদর্শ বীজ তলা তৈরি
সম্পর্কে বিস্তারিত।
পেইজ সূচিপত্রঃ-বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি সম্পর্কিত
- বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি
- বীজ বাছাইকরণ পদ্ধতি
- ধান বীজের অঙ্কুরোদগম পদ্ধতি
- বীজতলার জমি নির্বাচন
- আমন ধান চাষ পদ্ধতি
- বীজ বপন পদ্ধতি
- চারার পরিচর্যা
- চারা তোলার সঠিক পদ্ধতি
- চারা রোপনের জন্য জমি তৈরি
- ধানে সার প্রয়োগের নিয়ম
- ধানের চারা রোপন পদ্ধতি
- বীজতলা তৈরির পদ্ধতি
- আদর্শ বীজতলার চিত্র
- আদর্শ বীজতলার মাপ
- ধানের ভালো চারার বৈশিষ্ট্য
- লেখক এর মন্তব্য:বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি
বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি
বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি করার জন্য সর্বপ্রথম জমি নির্বাচন করা
জরুরী। আদর্শ বীজতলা তৈরির জন্য আদর্শ জমি নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ
একটি বিষয়। চলুন নিচে জেনে নেওয়া যাক একটি আদর্শ বীজতলা তৈরি করতে হলে
কোন কোন নিয়ম গুলো আমাদের অনুসরণ করা উচিত।
বীজ বাছাইকরণ পদ্ধতি
বীজ বাছাইকরণ পদ্ধতি হলো ধান চাষের জন্য সর্বপ্রথম ধাপ।বীজ বাছাই যত
সুন্দর ভাবে করতে পারব তত ভালো বীজ তৈরি করা সম্ভব হবে।তাই
বীজ বাছাইকরণ প্রক্রিয়া সম্বন্ধে ভালোভাবে জানা দরকার।বীজ বাছাইকরণের নিয়ম গুলো নিচে দেওয়া হলঃ
-
পুষ্ট বীজ এবং এর ও অঙ্গুরোধগম ক্ষমতা থাকতে হবে ৮০%।
- ৮ থেকে ১০ লিটার পানিতে ৩৮০ গ্রাম ইউরিয়া সার মেশাতে হবে।
-
ইউরিয়া মেশানো পানিতে ১০ কেজি বীজ ছেড়ে দিতে হবে তারপর এক থেকে দুই মিনিট
নাড়াতে হবে।
- হালকা অপুষ্ট বিজ গুলো উপরে ভেসে যাবে সেগুলো ফেলে দিতে হবে এবং পুষ্ট বীজগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
ধান বীজের অঙ্কুরোদগম পদ্ধতি
ধান বীজের অঙ্কুরোদগম পদ্ধতি হলো ২য় ধাপ। বীজে যদি কোন রোগ বোঝা যায়
তাহলে কারবেনডাজিম নামক ছত্রাক নাশক দিয়ে শোধন করে নিতে হবে। আউশ ও আমল ধানের
ক্ষেত্রে ৪০ থেকে ৫০ ঘন্টা এবং বোরো এর ক্ষেত্রে ৬০ থেকে ৭০ ঘন্টা জাগ
দিতে হবে। আউশ ও আমল ধানের ক্ষেত্রে ৪০ থেকে ৫০ ঘন্টা পানিতে(বস্তায় ভরে অথবা
যেভাবে সম্ভব) ভিজিয়ে রাখতে হবে।পানি থেকে তুলে(আবহাওয়া ঠান্ডা হলে) পানি
মুক্ত করে বীজ গরম করে নিতে হবে।
বীজ গরম করার পদ্ধতিঃ
মাটির ওপরে কিছু খরকুটা(বীজের পরিমাণ অনুযায়ী) দিয়ে তার উপরে পলিথিন দিতে
হবে। তার উপরে বীজগুলো সুন্দরভাবে বিছিয়ে দিতে হবে। তার উপর আরেকটা পলিথিন
দিয়ে বীজগুলো ঢেকে দিতে হবে। তার ওপর কিছু খরকুটো চাপিয়ে দিতে হবে। বোরো
ধানের ক্ষেত্রে ৬০ থেকে ৭০ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলেই অংকুর বের হয়।
বীজতলার জমি নির্বাচন
বীজতলা তৈরির জন্য বীজতলার জমি নির্বাচন হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। দোআঁশ ও
এটেঁল মাটি বীজতলার জন্য উপযুক্ত। খোলা ও রোদ যুক্ত স্থানে বীজতলা
তৈরি করা উচিত। এসব মাটিতে বীজতলা তৈরি করলে বীজ ভালো ও পুষ্ট হয়।
আমন ধান চাষ পদ্ধতি
আমন ধান চাষ পদ্ধতি,ভালোভাবে বীজ গজানোর জন্য আমন ধান চাষ পদ্ধতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি
বিষয়। ধানের বীজতলা তৈরির জন্য ৪ থেকে ৫ বার চাষ দিয়ে দিতে
হবে। এভাবে চাষ দিয়ে বীজতলা তৈরি করলে বীজ অনেক ভালো হয়।
বীজ বপন পদ্ধতি
বীজ বপন পদ্ধতি,বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি করার জন্য বীজ বপন পদ্ধতি এই ধাপটি অনেক
গুরুত্বপূর্ণ। ২ বীজ তলার মাঝে ৪০ সেন্টিমিটার ফাঁকা ও ১৫ সেন্টিমিটার গভীর
নালা রাখতে হবে এবং সেই নালার মাটিগুলো দিয়ে দুই পাশ উঁচু করে দিতে
হবে। অংকুর বীজ প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম হারে সমান
দূরত্বে বীজ বপন করতে হবে।
প্রতি ৩৩ শতক(এক বিঘা) জমিতে রোপনের জন্য ৩.৫থেকে
৪.৫ কেজি বীজ বপন করতে হবে। ১.৫ শতাংশ বীজতলা চারা দিয়ে ৩৩ শতাংশ(এক বিঘা)
জমিতে চারা রোপন করা যাবে।
চারার পরিচর্যা
চারার পরিচর্যা এর জন্য চারার সঠিক পরিচর্যা ও পদ্ধতি
অনুসরণ করা জরুরী। বীজ বপণের দিন থেকে শুরু করে তিন থেকে চার
দিন বীজতলায় পানি রাখতে হবে। তিন থেকে চার দিনের মধ্যে মাটিতে শিকড় লেগে
যাবে। তাই তিন থেকে চারদিন পর বীজতলা থেকে পানি বের করে দিতে হবে। কিছুদিন
পর বীজের উচ্চতা অনুযায়ী পানি রাখতে হবে।
চারার পাতা হলুদ হলে প্রতি বর্গ
মিটারে ৮ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।পোকার আক্রমণ দেখা দিলে কৃষি
কর্মকর্তার পরামর্শ অনুযায়ী কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
চারা তোলার সঠিক পদ্ধতি
চারা তোলার সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে চারা তুললে চারা অনেক ভালো উঠে। চারা তোলার
পূর্বে জমিতে বেশি পরিমাণে পানি রাখতে হবে। এর ফলে চারার মাটি নরম হবে ও
যারা ভালোভাবে তোলা যাবে।
চারা রোপনের জন্য জমি তৈরি
চারা রোপনের জন্য জমি তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চারা রোপনের দুই থেকে তিন
সপ্তাহ পূর্বে জমিতে দুই থেকে তিনটি চাষ দিয়ে রাখতে হবে। চারা রোপনের
দুইদিন আগে দুইটি চাষ দিয়ে মই দিয়ে জমি প্রস্তুত করতে হবে। মনে রাখতে
হবে জমিতে যেন কোথাও উঁচু কোথাও নিচু না থাকে।
ধানে সার প্রয়োগের নিয়ম
ধানে সার প্রয়োগের নিয়ম,ইউরিয়া ব্যতীত সব সার প্রয়োগ করতে হবে। জমি প্রস্তুত এর সময় জমির উর্বরতা
বৃদ্ধির জন্য বিঘা প্রতি ৮ থেকে ১০ কেজি টিএসপি, ১০ থেকে ১১ কেজি এমপি ও ৫
থেকে ৭ কেজি জিপসাম ১ কেজি দস্তা দিতে হবে।
চারার উপযুক্ত বয়সঃ
আমলঃ ২৫ - ৩০ দিন
আউশঃ ২২- ২৫ দিন
বোরোঃ ৪০- ৪৫ দিন
ধানের চারা রোপন পদ্ধতি
ধানের চারা রোপন পদ্ধতি মেনে চারা রোপন করতে হবে। চারা লাইনে লাইনে রোপন করতে
হবে। বোরো ও আমল মৌসুমে ২০-২৫ সে.মি. এবং আউশ মৌসুমে ২০-২৫
সে.মি. দূরে দূরে রোপন করতে হবে। এভাবে সাড়িতে সাড়িতে রোপন করলে ফলন এর
পরিমাণ ২০-২৫% বৃদ্ধি পায়।
বীজতলা তৈরির পদ্ধতি
বীজতলা তৈরির পদ্ধতি গুলো অনুসরণ করে আমাদের বীজতলা তৈরি করতে হবে। আমরা সকলেই
জানি বোরো ধান হলো একটি সৃজন ভিত্তিক ফসল।তাই অগ্রায়ন মাস হলো বীজতলা তৈরির
উপযুক্ত সময়।রোদযুক্ত,উর্বর ও পানির উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকে এরকম স্থানে বীজতলা
তৈরি করতে হবে। জমিতে চাষ দেওয়ার আগে প্রতি বর্গমিটারে(প্রায় ১ফুট x ৩.৫ফুট)
জায়গার জন্য ২-৩ কেজি জৈব সার দিয়ে ভালোভাবে জমি চাষ দিয়ে প্রস্তুত করতে হবে।
পানি দিয়ে জমিকে কাঁদা করে নিতে হবে এবং ১মিটার চওড়া ও জমির দৈর্ঘ্য অনু্যায়ী
ভেজা বীজতলাতৈরী করতে হবে। যেসব এলাকাই ঠান্ডার প্রকপ বেশি সেসব এলাকায় শুকনো বীজতলা তৈরি
করতে পারেন।
জমির গঠন অনুযায়ী নিচের বোরো ধানের বীজগুলো উপযুক্তঃ
- যেসব এলাকায় সেচের পানির ঘাটতি সেসব এলাকার জন্য-ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৪৫ এবং ব্রি ধান২৮
- পানির ঘাটতি নাই এবং উর্বর জমির জন্য- ব্রি ধান ২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৮,ব্রি ধান৫৯, ব্রি ধান৬০,ব্রি হাইব্রিড ধান১, ব্রি হাইব্রিড ধান২,ব্রি হাইব্রিড ধান৩
- ঠান্ডা প্রকোপ এলাকার জন্য-ব্রি ধান৩৬
- হাওড় এলাকার জন্য- বিআর১৭, বিআর১৮, বিআর১৯
- লবনাক্ত এলাকার জন্য- ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৫৫ এবং ব্রি ধান৬১
বীজ বপন করার আগে ৬০-৭০ ঘন্টা বীজগুলো যাগ দিয়ে রাখতে হবে তাহলে অংকুর
বের হবে। অংকুর বের হলে বীজগুলো জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। প্রতি বর্গমিটার
বীজতলার জন্য ৮০-১০০ গ্রাম বীজ বপন করতে হবে।
আদর্শ বীজতলার চিত্র
আদর্শ বীজতলার চিত্র,আমরা এতক্ষন বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা নিয়ে আলোচনা করলাম। তাহলে আমাদের মনে
প্রশ্ন আসতেই পারে একটি আদর্শ বীজতলার চিত্র কেমন হয়? চলুন নিচে
দেখে নেওয়া যাক একটি আদর্শ বীজ তলার চিত্রঃ
চিত্রঃ একটি আদর্শ বীজতলা
আদর্শ বীজতলার মাপ
আদর্শ বীজতলার মাপ কতটুকু হওয়া প্রয়োজন? নিশ্চয় এ নিয়ে আপনাদের মনে প্রশ্ন
তৈরি হয়েছে? চলুন তাহলে আজ এর সমাধান জেনে নেই খুব সহজেই।
আদর্শ বীজতলার মাপঃ
- বীজতলার আকার ৩×১ মিটার চওড়া হতে হবে
- ৭-৮ সেমি(রবি মৌসুমে) বা ১০-১৫ সেমি(বর্ষা মৌসুমে) একাধিক উচুঁ বীজতলা হলে দুই বীজতলার মাঝে ৩০ সেমি. চওড়া ফাঁকা জায়গা রাখতে হবে,যাতে সেচ ও চলাফেরার জন্য সুবিধা হয়।
ধানের ভালো চারার বৈশিষ্ট্য
ধানের উপযুক্ত ফলনের জন্য ধানের ভালো চারার বৈশিষ্ট্য গুলো সম্পর্কে আমাদের জেনে
নেওয়া দরকার। চলুন নিচে জেনে নেয়া যাক ভালো চারার বৈশিষ্ট্য গুলোঃ
-
বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ৭০-৮০% হতে হবে
- বীজ পুষ্ট ও পরিষ্কার থাকতে হবে
-
চারা বের হওয়ার পর চারার পাতা সবুজ থাকতে হবে
- প্রত্যেকটা বীজ থেকে বের হওয়া চারা সবুজ ও সতেজ থাকতে হবে
লেখক এর মন্তব্য:বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি
বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি,আমরা উপরে জানতে পারলাম কিভাবে বোরো ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি করতে হয় এবং তা পরিচর্যা
ও রোপণ সবকিছু সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম। উপরোক্ত বিষয় গুলো মেনে বীজতলা
তৈরি, বীজ বাছাইকরন, বীজতলার জমি নির্বাচন, বীজ রোপন ও চারার পরিচর্যা করলে ধানের
ফলন ২০-২৫% অগ্রিম বেশি আশা করা যায়।
আমরা সকলেই উপরোক্ত বিষয়গুলো মেনে ধানের
বীজতলা তৈরি করুন কার্য পরিচালনা করব। তাহলে অবশ্যই ধানের ফলন ভালো হবে। লেখনের মধ্যে যদি কোথায় কোন ভুল হয়ে থাকে তাহলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। এবং সংশোধনের প্রয়োজন মনে হলে ফ্রিলার্নিং আইটির যোগাযোগ পেজে গিয়ে যোগাযোগ করুন। ধন্যবাদ
ফ্রিলার্নিং আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url